জিরো বাউন্ডারি কবিতার ষষ্ঠ সংখ্যার জন্য লেখা জমা দেওয়ার লাস্ট ডেট জুলাই মাসের ১০ তারিখ। দুটো কবিতা বা কবিতা বিষয়ক লেখা নিজের এক কপি ছবি সমেত পাঠিয়ে দিন আমাদের ইমেলে-0boundarykabita17@gmail.com

পবিত্র চক্রবর্তী



আবহমানের কবিতা

আদিমযুগ থেকে মানুষ গুহার বসবাস থেকে ক্রমান্বয়ে সভ্যতার পথে অগ্রসর হতে শুরু করে । আর এই ধারাবাহিকতার প্রবাহ নিরন্তর বয়ে চলেছে । এক সময়ে মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করত আকারে ইঙ্গিতে । তারপরে সভ্যতার কালচক্র যত এগোতে থাকে ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমও পরিবর্তিত হতে থাকে । একে অপরের ভাব বিনিময়ের পরিভাষাও তুল্যমূল্য ভাবে বিকাশের পথে যাত্রা করতে থাকে ।

ধ্বনি থেকে বর্ণ এবং বর্ণ থেকে বাক্য – তরঙ্গের এই ধারায় মানুষ ক্রমশ মনের ভাবকে আরো বেশী ভাবমধুর করার নিমিত্তে প্রকৃতি প্রদত্ত ছন্দকে ভাব প্রকাশের মাধ্যম তথা মনোরঞ্জনের উপাদান করতে থাকে । বর্তমান আলোচনাকে কয়েকটি পর্যায়ে বিভক্ত করে মূল বিষয়কে আলোকিত করা হল । 

ইঙ্গিত থেকে কাব্য – পূর্বে গৌরচন্দ্রিকায় আলোচিত হয়েছে মানুষ তার ভাব প্রকাশকে ছন্দময় করে তলার জন্য স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই প্রকৃতির সাহায্য গ্রহন করে । তারই ফল হিসাবে কেবলমাত্র আকার-ইঙ্গিতের মধ্যে প্রবেশ ঘটে তাল-ছন্দ-লয় এবং ক্রমশ নানা পরিমার্জনার অভিযোজন স্বরূপ সৃষ্টি হয় কথা থেকে কাব্যের । তবে একথা স্বীকার্য যে প্রাচীনকালে সাহিত্যগত উপাদানের মধ্যে কবিতার জন্ম প্রথম এবং তারপর ভাবের বিস্তার হিসাবে গল্পের ভূমিষ্ঠ হওয়া । 

কবিতা কি ও তার জন্মকাল  - যে লেখাটি সমকালের স্মৃতি বা স্বপ্নকে তুলে আনতে সক্ষম এবং একই সাথে সমকালকে অতিক্রের যোগ্যতা রাখে তাকেই বোধহয় কবিতা বলা যেতে পারে । কেউ কেউ স্বীকার করেন ,” পয়েট্রি ইজ ইমিটিশন অব লাইফ,ক্রিটিসিজম অব লাইফ,মিরর অব লাইফ”।

সাহিত্যের প্রধান শাখাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো কবিতা। ‘কবিতা' সাহিত্যের আদি ও প্রাচীনতম শাখা। সকল ভাষারই প্রাচীন নিদর্শন হলো ‘কবিতা'। উল্লেখ্য এক্ষেত্রে প্রামাণ্য হিসাবে মহাভারত তথা রামায়ণ আদি গ্রন্থদ্বয় । যদিও এর ভাষা দেবনাগরী । তবুও ভারতীয় সংস্কৃতির আদি কাব্য-গ্রন্থকান্ডারী হিসাবে এদের নাম গুরুত্বপূর্ণ । অন্যদিকে ভারতীয় সাহিত্যে বেদ-নানা পুরাণ ইত্যাদিও সম্পূর্ণরূপে ছন্দময় কাব্য ভাষায় জাজ্বল্যমান ।
কবিতার শ্রেণী বিভাগ - কবিতা শিল্পের একটি শাখা যেখানে ভাষার নান্দনিক গুণাবলির ব্যবহারের পাশাপাশি ধারণাগত এবং শব্দার্থিক বিষয়বস্তু ব্যবহার করা হয়। মানুষ যত ক্রম উন্নতির পথে এগোতে থাকে ততই ভাষা ও তার ব্যভারের মাধ্যমও উন্নতি সাধনের পথে এগোতে থাকে । বিশেষত নান্দনিক এই ভাবের গঠন , প্রয়োগরীতি প্রভৃতির উপর নির্ভর করে কবিতার বস্তু ও রচনাশৈলীর নানা শ্রেনী বিভাজিত হতে থাকে নানা শাখাপ্রশাখায় । যেমন –

রুবাই

এটি আরবীয় অঞ্চলের চার পংক্তির একটি কবিতা। ওমর খৈয়াম তাঁর রুবাই-এর জন্য বিখ্যাত।

সিজো

এটি সীমিত দৈর্ঘ্যের কোরীয় কবিতা। সাধারণত ৪ পংক্তিতে লেখা হয়।
ক্বাসিদা
  আধুনিক কবিতা

চতুর্দশপদী

    চতুর্দশপদী (Sonnet) হল এক ধরনের কবিতা যার উদ্ভব হয় ইউরোপে। এর বৈশিষ্ট হল যে এরূপ কবিতাগুলো ১৪টি চরণে সংগঠিত এবং প্রতিটি চরণে মোট ১৪টি অক্ষর থাকবে।

হাইকু

হাইকু (একবচনে "হাইকি") একধরনের সংক্ষিপ্ত জাপানি কবিতা। তিনটি পংক্তিতে যথাক্রমে ৫, ৭ এবং ৫ জাপানি শ্বাসাঘাত মোরাস মিলে মোট ১৭ মোরাসের সংক্ষিপ্ত পরিসরে একটি মুহূর্তে ঘটিত মনের ভাব প্রকাশ করা হয়।

গজল

গজল আরব থেকে এর উৎপত্তি হলেও ফার্সি ভাষায় এটি বিশেষ বিকাশ লাভ করে। পরবর্তীতে উর্দু ভাষায় এটি সমধিক জনপ্রিয়তা পায়। আরবি, ফার্সি, পশতু, উর্দু ছাড়াও হিন্দি, পাঞ্জাবী, মারাঠি, বাংলা এমনকি ইংরেজিতেও গজল লেখা হয় । 

 এছাড়াও রয়েছে শব্দকবিতা , চ্যাটি কবিতা , আখ্যান কবিতা , মহাকাব্য , নাট্যকাব্য , বিদ্রুপাত্মক কবিতা , গীতিকাব্য , শোককাব্য ইত্যাদি । 

উক্ত নানা ধারার মধ্য দিয়ে প্রাচীন কাব্য কথা থেকে বর্তমানের কবিতা নানা গতি প্রকৃতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে । হচ্ছেও নানা পরীক্ষানিরীক্ষা । কিছু বিষয় ও আঙ্গিক যেমন আধুনিক কালের কবিতার ভাবধারা থেকে বিলুপ্ত হয়েছে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী । 

বাংলা সাহিত্য কালবিচারে বাংলা সাহিত্যকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়: প্রাচীন যুগ (৬৫০-১২০০), মধ্যযুগ (১২০০-১৮০০) ও আধুনিক যুগ (১৮০০-)। মধ্যযুগ আবার তিনভাগে বিভক্ত: আদি-মধ্যযুগ (১২০০-১৩৫০), মধ্য-মধ্যযুগ (১৩৫০-১৭০০) ও অন্ত্য-মধ্যযুগ (১৭০০-১৮০০)। অনুরূপভাবে আধুনিক যুগও কয়েকটি ভাগে বিভক্ত: প্রস্ত্ততিপর্ব (১৮০০-১৮৬০), বিকাশের যুগ (১৮৬০-১৯০০), রবীন্দ্রপর্ব (১৯০০-১৯৩০), রবীন্দ্রোত্তর পর্ব (১৯৩০-১৯৪৭) এবং বাংলাদেশ পর্ব (১৯৪৭-)

এই দীর্ঘ পথ ও ইতিহাসকে সংক্ষেপে আলোচনা এবং বোঝার সুবিধার জন্য আমরা  তিনটি ভাগে ভাগ করে নিচ্ছি । সেগুলি হল –
১) রবীন্দ্র পূর্ববর্তী যুগ ২) রবীন্দ্র সমসাময়িক যুগ ৩) রবীন্দ্র পরবর্তী যুগ ।


রবীন্দ্র পূর্ববর্তী যুগ –

সাধারণভাবে খ্রিস্টীয় ১৩শ-১৪শ শতক পর্যন্ত কাল বাংলা সাহিত্যের আদি-মধ্যযুগ বা চৈতন্যপূর্ব যুগ বলে চিহ্নিত। এ সময়ের বাংলা সাহিত্য তিনটি প্রধান ধারায় বিকশিত হয়েছে:  বৈষ্ণব সাহিত্য, মঙ্গল সাহিত্য এবং অনুবাদ সাহিত্য।  বড়ু চন্ডীদাস (১৪শ শতক) এ সময়ের প্রথম উল্লেখযোগ্য কবি, যিনি রাধাকৃষ্ণের প্রণয়বিষয়ক নাটগীতিকাব্য রচনা করেন। তাঁর আগে কবি  জয়দেব সংস্কৃত ভাষায় রাধা-কৃষ্ণের প্রেমমূলক যে গীতিসাহিত্যের প্রবর্তন করেন, চন্ডীদাস সেই ধারাকেই বিকশিত করে তোলেন।

চৈতন্যদেবের আগে-পরে রচিত সহস্রাধিক বৈষ্ণব পদের ভণিতায় একাধিক চন্ডীদাসের নাম পাওয়া যায় আদি চন্ডীদাস, কবি চন্ডীদাস, দ্বিজ চন্ডীদাস ও দীন চন্ডীদাস। এঁরা এক না পরস্পর ভিন্ন তা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে বিতর্ক আছে, যা ‘চন্ডীদাস সমস্যা’ নামে পরিচিত। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভের সম্পাদনায়  বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে  শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামে যে পুথিটি প্রকাশিত হয়, তার ভণিতায় বড়ু চন্ডীদাসের নাম পাওয়া যায়। সম্ভবত ইনিই আদি চন্ডীদাস, যাঁর কাব্যের রচনাকাল ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ বলে ধরা যায়।  মালাধর বসু সংস্কৃত শ্রীমদ্ভাগবত অবলম্বনে পয়ার ছন্দে কৃষ্ণলীলা বিষয়ক উপাখ্যান  শ্রীকৃষ্ণবিজয় রচনা করেন ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। এই কাব্যের জন্য গৌড়েশ্বর তাঁকে ‘গুণরাজ খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এটি ‘মঙ্গল’ বা ‘বিজয়’ জাতীয়  পাঁচালি বা আখ্যানকাব্য হিসেবে পরিচিত; তাই এর অন্য নাম গোবিন্দমঙ্গল  বা গোবিন্দবিজয়। এই পাঁচালিকাব্য বাংলার অনুবাদ শাখারও একটি প্রাচীনতম নিদর্শন বলে অনেকে মনে করেন ।

এ যুগেই রামায়ণ,  মহাভারত, ভাগবত প্রভৃতি অনুবাদকাব্যের রচনা শুরু হয়। এ ব্যাপারে মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সময় বাংলা সাহিত্যের বিকাশে সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহ, তাঁর পুত্র নসরৎ শাহ (১৫১৯-৩২) এবং সেনাপতি পরাগল খাঁর উৎসাহ ও অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়।  ব্রজবুলিভাষায় বাঙালিদের পদ-রচনার শুরুও এ সময়েই। এ সময়  কবি কঙ্ক সত্যপীরের মহিমা প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় সর্বপ্রথম  বিদ্যাসুন্দর কাহিনী রচনা করেন (আনু. ১৫০২)। চৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) আবির্ভাবও এ সময়। তিনি স্বপ্রতিষ্ঠিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবমত বাংলা ভাষায় প্রচার করলে বাংলা সাহিত্যের নতুন দিক উন্মোচিত হয় এবং বৈষ্ণব সাহিত্যেরও ভিত্তি স্থাপিত হয়এ যুগেই রামায়ণ,  মহাভারত, ভাগবত প্রভৃতি অনুবাদকাব্যের রচনা শুরু হয়। এ ব্যাপারে মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সময় বাংলা সাহিত্যের বিকাশে সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহ, তাঁর পুত্র নসরৎ শাহ (১৫১৯-৩২) এবং সেনাপতি পরাগল খাঁর উৎসাহ ও অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়।  ব্রজবুলিভাষায় বাঙালিদের পদ-রচনার শুরুও এ সময়েই। এ সময়  কবি কঙ্ক সত্যপীরের মহিমা প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় সর্বপ্রথম  বিদ্যাসুন্দর কাহিনী রচনা করেন (আনু. ১৫০২)। চৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) আবির্ভাবও এ সময়। তিনি স্বপ্রতিষ্ঠিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবমত বাংলা ভাষায় প্রচার করলে বাংলা সাহিত্যের নতুন দিক উন্মোচিত হয় এবং বৈষ্ণব সাহিত্যেরও ভিত্তি স্থাপিত হয় ।

মঙ্গলকাব্য বাংলার নিজস্ব উপাদানে রচিত লৌকিক দেবমাহাত্ম্যমূলক কাহিনীকাব্য। পাঁচালি কিংবা পালার আকারে চৈতন্যপূর্ব যুগেই এগুলি রচিত হয়। এগুলির নাম কেন  মঙ্গলকাব্য হয়েছে সে সম্পর্কে মতভেদ আছে। এর পালা এক মঙ্গলবারে শুরু হয়ে আরেক মঙ্গলবারে শেষ হতো বলে কেউ কেউ একে মঙ্গলকাব্য বলেছেন। নামকরণের ক্ষেত্রে এরূপ একটি কারণকে বিবেচনা করা হলেও মূলত কাব্যগাথার মাধ্যমে দেবদেবীর মাহাত্ম্য প্রচার এবং তা শ্রবণে ধর্মীয় বিনোদনের সঙ্গে মঙ্গল কামনাই বাঙালি হিন্দু কবিকে মঙ্গলকাব্য রচনায় উৎসাহিত করে। প্রাকৃতিক প্রতিকূলতায় পূর্ণ বঙ্গদেশে তাই অবশ্যম্ভাবিরূপে এসেছে পুরাণের দেবদেবীরা এবং ভক্তমনের কল্পনাপ্রবাহে অসংখ্য মানব ও অতিমানব; আর চরিত্রগুলিও হয়ে উঠেছে শাশ্বত বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া সংগ্রামী মানুষের প্রতীক। এই কাব্যগুলি থেকে বাংলাদেশের তৎকালীন ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ, কৃষি, বাণিজ্য, অর্থনীতি প্রভৃতি সম্বন্ধে অনেক তথ্য জানা যায়।

মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন  মনসামঙ্গল, তন্মধ্যে বিজয়গুপ্তের পদ্মাপুরাণ (১৪৯৪) সর্বাধিক জনপ্রিয়। মনসামঙ্গল এক সময় পূর্ববঙ্গের জাতীয় কাব্যের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। মঙ্গলকাব্যের ইতিহাসে চন্ডীমঙ্গল কাব্যধারা উৎকর্ষের জন্য বিখ্যাত।

প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে উনিশ শতক হচ্ছে বাঙালির নবজাগরণের যুগ। এ সময় বাঙালি-প্রতিভার সর্বতোমুখী বিকাশ ঘটে এবং জাতি হিসেবে বাঙালির অভ্যুদয়ের সর্ববিধ প্রচেষ্টারও সূত্রপাত ঘটে। এ যুগেই একটি শক্তিশালী সাহিত্যেরও সৃষ্টি হয়।  অর্থাৎ এই সময় থেকে বাংলা সাহিত্যে কবিতার প্রসার কিছুটা কমে গদ্য সাহিত্যের বিকাশ হতে থাকে । 
রবীন্দ্র সমসাময়িক যুগ -  বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের প্রথম পর্ব নির্মাণ করেন পাদ্রি আর সংস্কৃত পন্ডিতরা। তাঁদের গদ্যরচনার মধ্য দিয়ে প্রারম্ভিক স্তরটি নির্মিত হয়। দ্বিতীয় পর্বে আগমন ঘটে চিন্তাশীল ও সৃষ্টিশীল বাঙালি কবি- সাহিত্যিকদের। তৃতীয় পর্বের ব্যাপ্তি কম হলেও এর রচনাসম্ভার উৎকৃষ্ট ও প্রাচুর্যময় এবং গোটা সময়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) প্রাধান্য বিস্তার করে আছেন। তাছাড়াও রয়েছেন নজরুল ইসলাম , দ্বিজেন্দ্র লাল রায় , আতুল প্রসাদ সেন প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক । জীবনানন্দ দাশ ঠিক এরপরেই বাংলা কবিতার হাল বয়ন করেন অন্যরূপে ।
রবীন্দ্র পরবর্তী যুগ  - একে তিরিশোত্তর বা রবীন্দ্রোত্তর পর্বও বলা হয়। অর্থাৎ ১৯৪৭ সাল এবং তার পরবর্তী সময়কে রবীন্দ্র পরবর্তী যুগ হিসাবে নির্ণয় ।  এরপর রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে সাহিত্যিক ভাবধারারও পরিবর্তন ঘটে; ফলে বাংলা সাহিত্য পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষত  কলকাতা এবং সদ্যোজাত পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ভিত্তিক দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। তাই সবশেষে যে পর্বের সূচনা হয় তাকে এক কথায় বাংলাদেশ পর্ব (১৯৪৭-) বলা চলে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ , মন্বন্তর ভারতের স্বাধীনতা এবং তারপরের পটভূমিকায় বাংলা কবিতা এক নবরূপে প্রকাশিত হতে থাকে । শুধু তাই নয় বাংলা কবিতায় আসে কার্ল মার্কসের দর্শন । এই সকল ভাবের কান্ডারী হতে থাকেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় , সুভাষ মুখোপাধ্যায় , শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ ।

৮০ এর দশকের শেষ ভাগ থেকে পুনরায় উঠে আসতে থাকেন নব কবি-বৃন্দ । যেমন – জয় গোস্বামী , পবিত্র চক্রবর্তী প্রমুখ কবিগণ ।

অতি সংক্ষেপে তিনকালের কবিগণ ও তাঁদের সৃজন – বাংলা কবিতার ইতিহাস ও কবি তালিকা সুদীর্ঘ । সমাজের নানা ভাবকে নিজের মনে জারিত করে কবি তার সৃষ্ট কবিতার দ্বারা বাংলার সাহিত্যকে করেছেন সমৃদ্ধ । পূর্বের মতই সংক্ষেপে  তাঁদেরও তিন ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা হল ।

প্রাচীন যুগ-

চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম কাব্য তথা সাহিত্য নিদর্শন। নব্য ভারতীয় আর্যভাষারও প্রাচীনতম রচনা এটি । চর্যাপদের ২৪ জন পদকর্তা হচ্ছেন লুই পা, কুক্কুরীপা, বিরুআপা, গুণ্ডরীপা, চাটিলপা, ভুসুক পা, কাহ্নপাদ, কাম্বলাম্বরপা, ডোম্বীপা প্রমুখ । তাদের সৃষ্ট পদের উদাহরণ –
শবরপাদের একটি পদে দেখা যায় নরনারীর প্রেমের এক অপূর্ব চিত্রণ-
উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।।
উমত সবরো পাগল শবরো মা কর গুলী গুহাডা তোহৌরি।
ণিঅ ঘরনি ণামে সহজ সুন্দারী।।

মধ্যযুগ - 


বাংলা সাহিত্যের ১২০০-১৩৫০ খ্রি. পর্যন্ত সময়কে “অন্ধকার যুগ” হিসেবে চিহ্নিত। এই সময় রচিত হয় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন যার রচয়িতা বডুচন্ডিদাশ এছাড়া বৈষ্ণব পদাবালী সাহিত্যের কবিগণ হলেন বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস প্রমুখ । তাঁদের রচিত পদের উদাহরণ –
 এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর ||৩||
ঝঞঝা ঘন গরজন্তি সন্ততি ভুবন ভরি বরিখিন্তিয়া।
কান্ত পাহুন কাম দারুণ সঘনে খর শর হন্তিয়া ||৭||
কুশিল শত শত পাত-মোদিত মূর নাচত মাতিয়া।
মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকী ফাটি যাওত ছাতিয়া ||১১||
তিমির ভরি ভরি ঘোর যামিনী থির বিজুরি পাঁতিয়া।
বিদ্যাপতি কহ কৈছে গোঙায়বি হরি বিনে দিন রাতিয়া ||১৫|| ( বিদ্যাপতি)

আধুনিক যুগ - 


১৮০০- বর্তমান, চলমান। মধ্য ও আধুনিক যুগের মধ্যে যিনি সেতুবন্ধন তৈরি করেন তিনি হলেন যুগ সন্ধি ক্ষণের কবি: ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯)। মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) মধ্যযুগীয় পয়ারমাত্রা ভেঙে কবি প্রবেশ করেন মুক্ত ছন্দে। রচনা করেন সনেট। লাভ করেন, আধুনিক কবিতার জনকের খ্যাতি। ভোরের পাখি : ইউরোপীয় ভাবধারার রোমান্টিক ও গীতি কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪)। মহিরুহ বৃক্ষের ন্যায় বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। মহাকাব্য ব্যতিত সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে তিনি খ্যাতির স্তম্ভটি প্রতিষ্ঠা করেননি। রবীন্দ্রানুসারী ভাবধারার অন্যান্য কবিরা হলো: সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত , যতীন্দ্রমোহন বাগচী। বিশ শতকের শুরুতে কবিতায় পঞ্চপুরুষ রবীন্দ্রবিরোধিতা করেন, তারা হলো : মোহিতলাল মজুমদার, কাজী নজরুল ইসলাম ও যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত । আধুনিক কবিতার স্বর্ণযুগ: রবীন্দ্র ভাবধারার বাইরে এসে দশক প্রথার চালু করেন তিরিশের পঞ্চপান্ডব কবি: অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-৮৭), জীবননান্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪), বিষ্ণু দে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ( ১৯৩৩-৯৫ )।

 বাংলা সাহিত্যের একবিংশ শতকের কবিদের মধ্যে রয়েছেন – জয় গোস্বামী ( ১৯৫৪ – বর্তমান ) প্রমুখ  ।

বর্তমান অর্থাৎ রবীন্দ্র সমসাময়িক কবি এবং পরবর্তীকালের কবিদের সৃষ্ট কবিতা পড়লে আমরা লক্ষ্য করব যে বাংলা কবিতা বর্তমানের সঙ্গে কতটা পরিবর্তিত হয়েছে । যেমন প্রথমেই আসি রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতায় –

গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা–
এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু-ধারে–
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্‌ বিদেশে,
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও,
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে...। ( সোনার তরী / সোনার তরী কাব্যগ্রন্থ ) ।


 কবির এই পেলবতা ও জীবন দর্শনের রূপ অনেকটা পরিবর্তিত হয়েছে জীবনানন্দ দাশের কবিতায় । তাঁর রোমান্টিকতা ঠিক এইরূপ –

শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে—ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ।
বধু শুয়ে ছিল পাশে—শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল—জ্যোৎস্নায়—তবু সে দেখিল
কোন্‌ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল—লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।
এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি!
রক্তফেনা মাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি
আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার;
কোনোদিন জাগিবে না আর...। (আট বছর আগের একদিন )

উক্ত দুই কবিতার মধ্য দিয়ে পরিলক্ষিত হচ্ছে সময়ানুসারে বাংলা কবিতার বক্তব্য তথা ভাব পরিবর্তিত হয়ে চলেছে । ৫০ এর দশকের পরেই বাংলার রাজনীতিতে আসে পরিবর্তনের স্পর্শ । আর সেই জাগরণের ছোঁয়া লাগে এর পরবর্তী কবি ও কবিতার আঙ্গিকে । শক্তি চট্টোপাধ্যায় তৎকালীন কবিদের মধ্যে অন্যতম । তাঁর সৃষ্ট একটি কবিতা হল –

অবনী বাড়ি আছো
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’

বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে–
‘অবনী বাড়ি আছো?’

আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয় পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছ ?’ (‘অবনী বাড়ি আছ?) 

এখানে কবির চেতনা ও ভাব প্রকাশ সম্পূর্ণ অন্যমাত্রায় । যে দর্শনে রবীন্দ্র নাথ থেকে শুরু করে জীবনানন্দ দাশ দেখেছেন , সেই দর্শন এবং রমান্টিকতার মধ্য দিয়ে বাস্তব বোধ বর্তমান সময়ের আঙ্গিকে অন্য মাত্রা পেয়েছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা ।

এবারে আসি বিংশ শতকের অন্তিম ভাগ এবং এক বিংশ শতকের প্রারম্ভিক পর্বের দুই কবির কবিতায় । জয় গোস্বামী  (নভেম্বর ১০, ১৯৫৪) বাংলা ভাষার একজন প্রখ্যাত আধুনিক কবি। পশ্চিমবঙ্গবাসী ভারতীয় এই কবি উত্তর-জীবনানন্দ পর্বের অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালিকবি হিসাবে পরিগণিত।

কে মেয়েটি হঠাৎ প্রণাম করতে এলে ?
মাথার ওপর হাত রাখিনি
তোমার চেয়েও সসংকোচে এগিয়ে গেছি
তোমায় ফেলে
ময়লা চটি, ঘামের গন্ধ নোংরা গায়ে,
হলভরা লোক, সবাই দেখছে তার মধ্যেও
হাত রেখেছ আমার পায়ে
আজকে আমি বাড়ি ফিরেও স্নান করিনি
স্পর্শটুকু রাখব বলে
তোমার হাতের মুঠোয় ভরা পুস্করিণী
পরিবর্তে কী দেব আর ? আমার শুধু
দু’ চার পাতা লিখতে আসা
সর্বনাশের এপার ওপার দেখা যায় না
কিন্তু আমি দেখতে পেলাম, রাঙা আলোয়
দাঁড়িয়ে আছে সে-ছন্দ, সে-কীর্তিনাশা ।
অচেনা ওই মেয়ের চোখে যে পাঠাল
দু’-এক পলক বৃষ্টিভেজা বাংলা ভাষা । (বৃষ্টি ভেজা বাংলা ভাষা )

উক্ত কবিতার মধ্যে পরিলক্ষিত হয় কবি সাধারণ এবং কথ্য বাংলা ভাসাকে কবিতায় ব্যভারের মাধ্যমে সমাজের চালচিত্রকে সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন । যেমন – “ময়লা চটি, ঘামের গন্ধ নোংরা গায়ে”।






No comments:

Post a Comment