ভাগাড়ের মাংস খাবার প্লেটে ওঠার খবরে বাঙালি যখন দ্বিধাবিভক্ত , কেউ ভাবছে ইসস টাকার জন্য এতো নিচে নামছে কেউ যুক্তি দিচ্ছে পুঁজি বাদীদের চাল ,ফুটপাথের দোকান বন্ধ করার ফিকির তখন এক সকালে এক বন্ধুর মেসেজ এলো।" রেস্টুরেন্টে মাংস খাওয়া তো বন্ধ এবার ফল খাওয়াও বন্ধ করতে হবে !"
গরম কালে ফলের মরশুমে ফল বন্ধের খবরে বাঙালি মরমে মরবে এ আর বলার অপেক্ষা রাখে না।বিষয় কি খোঁজ নিতে গিয়ে যখন গুগল কে চাপ দিচ্ছি আমার ফোনের ঘন্টি বেজে উঠলো। ওপারে আমার এক পরিচিত বন্ধু। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। যে কোনো নতুন খবরে বিশেষ করে খাওয়া বা স্বাস্থ্য যেখানে জড়িয়ে আমাকে সত্বর ফোন করে। ওজন অনেক চেষ্টায় একশতে কমিয়ে এনেছে।এমনিতে মেনু কিছুটা কাটছাঁট হয়েছে। তবু এমন একটা নাম যা কিনা স্বাস্থ্য এবং খাদ্য উভয় ব্যাপারে জড়িয়ে গেছে তেমন একটা বিষয়ে মৃগাঙ্কর ফোন না আসাটাই অবিশ্বাস্য!অতএব সঙ্গত কারণেই সকাল সকাল ফোন টা এসেছে। ডেঙ্গুর মরসুমেও অনেকবার ফোন এসেছিল। যেকোনো মামুলি সমস্যাকে মৃগাংকর ডেঙ্গি মনে হতো সেসময়। যে যাই হোক এবারের বার নেপো নয় নীপায় নাকি দই মেরে থুড়ি দাঁও মেরে যাচ্ছে।
-দাদা একটু বলবে
-কি বলবো ! শরীর ঠিক আছে?
-শরীর তো ঠিক আছে তবে খবর টাতে একটু চিন্তা হচ্ছে ! বুঝতেই পারছো
-বুঝতে পারছি ! নিপা তো?
-হ্যা দাদা। মানে কি কি খাওয়া বারণ বা ঠিক কিভাবে ছড়ায় একটু যদি বলতে
প্রশ্ন গুলো খুবই প্রাথমিক স্তরে। আতঙ্ক যে ভালো রকম ছড়িয়েছে সেটা বুঝতে আর বাকি নেই। এবারে মূলতঃ কেরালা তে পাওয়া গেছে নীপার কেস। যাইহোক যেকোনো আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ কে যেটা করতে হয় সেটা হলো আশ্বস্ত। সেটা আর প্রাথমিক কিছু প্রতিরোধ বা লক্ষণ জানিয়ে ফোন রাখলাম।
ফোন তো রাখলাম। তবু প্রসঙ্গ পিছু ছাড়লো কই।সুলুক সন্ধানে কেটে গেলো পুরো সকাল।সাধের গ্রিন টি লীন তাপ ছেড়ে কখন গোল্ডেন সরবত হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। তথ্য তলাসে উঠে এলো তেতো সত্য অনেক কথা...
এই নিপা ভাইরাসে প্রথম আক্রান্ত হন মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে শুকর ফার্মের কর্মচারী ১৯৯৮ সালে নিপা নামক গ্রামে। এই ভাইরাস চিহ্নিত হয় ১৯৯৯ সালে। সে সময় মোট ২৬৫ জন আক্রান্তের খবর মেলে মারা যান ১০০ জন।
এরপর ২০০১ সালে বাংলাদেশে এই রোগ দেখা যায় তারপর ২০১২ পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছর বাংলাদেশে কিছু জায়গায় নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। ২০১২ সালের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ২০৯ জন। মারা গেছেন ১৬১ জন অর্থাৎ মৃত্যুর হার ৭৭%
ভারতে প্রথম দেখা যায় ২০০১ সালে।পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে ২০০১ সালে ৬৬ জন আক্রান্ত হন মারা যান ৪৫ জন তারপর নদীয়া জেলাতে ২০০৭ সালে আক্রান্ত হন ৫ জন ।দুর্ভাগ্য বসত ৫ জনই মারা যান। ভারতে নিপা ভাইরাসের মারণ হার ৭০%
এবছর কেরালায় আবার দেখা যায় নিপা ভাইরাস। এক গ্রামে কুয়োর ভেতর বাসা বেঁধে ছিলো বাদুড়।সেই কুয়োর সংক্রমিত জল থেকে ছড়ায়।
২৮ শে মে পর্যন্ত ১৩ জন মারা গেছেন কেরালায়। কোঝিকড় এবং মালাপ্পুরাম এ যথাক্রমে ১০ জন ও ৩ জন এদের মধ্যে ৩১বছর বয়সী এক নার্স ও আছেন যিনি নিপা আক্রান্ত রোগীর থেকে এই রোগে পড়েন। ১৬ জন কে নিপা আক্রান্ত সন্দেহ করা হচ্ছে এবং ৭৫৩ জনকে observation রাখা হয়েছে।
প্রধানত ফলাহারী বাদুড় থেকে এই রোগ ছড়ায়।এই রোগের জীবাণু বাদুড় বা শুকরের দেহেই মূলতঃ থাকে।জীবাণু বহন করলেও এরা রোগাক্রান্ত হয় না। দুর্ভাগ্যক্রমে মানুষের শরীরে এই জীবাণু ঢুকলে মানুষ আক্রান্ত হন। শরীরে ঢোকার ৫ থেকে চোদ্দো দিনের মাথায় লক্ষণ দেখা যায়। শুরুটা আর সব ভাইরাল রোগের মতই হয়। জ্বর ,গায়ে ব্যথা ,মাথা ব্যাথা ,বমি ভাব। খারাপ লক্ষণ মূলত দুরকম। এক encephalitis ( ভুল বকা, খিঁচুনি,এমনকি কোমা) দুই শ্বাস যন্ত্রের সমস্যা অর্থাৎ কিনা শ্বাস কষ্ট(এক্ষেত্রে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র বা ভেন্টিলেটর এর সাহায্য নিতে হতে পারে).সব ক্ষেত্রেই মৃত্যু একমাত্র পরিণতি তাই নয়। ৭৪.৫% ক্ষেত্রে (৫০_৭৫%) মৃত্যুর আশঙ্খা থাকে।
তাল সাস,সবেদা ,কলা জাতীয় খাবার বা ফলাহারি বাদুড় খাওয়া ফল খেলে,বাদুড়ের ইউরিন বা স্টুল দিয়ে দূষিত জল বা খাবার খেলে এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। এই সব খাবার থেকেই মূলতঃ শুকরের দেহে এই রোগের জীবাণু ঢোকে।তাই শুকর প্রতিপালন যারা করেন তারা এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা আছে। আক্রান্ত রোগীর বাড়ির লোকজন এবং ডাক্তার নার্স তথা স্বাস্থ্য কর্মীরাও সহজে আক্রান্ত হতে পারেন যদিনা suspected case এবং কনফার্ম কেস গুলোকে আলাদা করে রাখা হয় ও সুরক্ষিত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়।
এখনও পর্যন্ত এ রোগের টিকা বা ওষুধ নেই তাই লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা( supportive treatment) একমাত্র উপায়। প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে।
খারাপ এবং দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি এই সব পশু বাহিত রোগের প্রকোপ আগামী দিনে আরো বাড়বে। কারণ খুবই স্পষ্ট। নগরায়ণ। পশুদের ডেরায় মানুষের প্রবেশ। ফলে যে রোগজীবাণু কেবল পশুদের শরীরে বাহিত হচ্ছিলো(zoonotic disease) মানুষ সে গুলোতে আজ আক্রান্ত হচ্ছে ।এর দায় আমরা এড়াই কি করে। দেরিতে হলেও অবসম্ভাবি ডাক তাই উঠবে "দাও ফিরে এসে অরণ্য/লও হে নগর"
তথ্যসূত্র :
১
২
৩
No comments:
Post a Comment